দুর্গাপুর, ১১ মে: রাজ্যের ৪২ টি লোকসভা আসনের মধ্যে বর্ধমান- দুর্গাপুর লোকসভা কেন্দ্রটি অন্যতম নজরকাড়া একটি কেন্দ্র।এই কেন্দ্রে তৃণমূল কংগ্রেসের তারকা প্রার্থী ১৯৮৩ ক্রিকেট বিশ্বকাপ জয়ী ভারতীয় ক্রিকেট দলের তারকা কীর্তি আজাদ। অন্যদিকে তার মূল প্রতিদ্বন্দ্বী ভারতীয় জনতা পার্টিকে এ রাজ্যে প্রতিষ্ঠা দেওয়ার অন্যতম প্রধান কারিগর হেভিওয়েট দিলীপ ঘোষ। আবার একসময়ের বামেদের শক্ত ঘাঁটিতে লাল ফেরাতে মরিয়া বাম শিবিরের প্রার্থী প্রাক্তন অধ্যক্ষ ড: সুকৃতি ঘোষাল। আর মাত্র ৪৮ ঘন্টা পরেই চতুর্থ দফার লোকসভা নির্বাচনে এই কেন্দ্রের ভোট। শনিবার ছিল প্রচারের শেষ দিন। দীর্ঘ প্রায় এক মাসেরও বেশি সময়কাল ধরে এই কেন্দ্রে সকলেই গণদেবতাদের আশীর্বাদ পেতে মরিয়া প্রচেষ্টা চালালেন।
২০১৪ সালে এই কেন্দ্রে পরিবর্তন আসে। বামেদের হাত থেকে ছিনিয়ে নিয়ে এই আসনে জয়লাভ করেন তৃণমূল কংগ্রেসের চিকিৎসক প্রার্থী ড: মমতাজ সংঘমিতা। কিন্তু পাঁচ বছর পরেই ২০১৯ সালে এই কেন্দ্রে ফের বদল ঘটে। দার্জিলিং ফেরত বিজেপি সাংসদ এস এস আলুওয়ালিয়া মাত্র ২৪০০ ভোটের ব্যবধানে হারিয়ে দেন মমতাজ সংঘমিতাকে। এবার অ্যাসিড টেস্ট এই কেন্দ্রে। কিন্তু প্রচারের শেষ দিন পর্যন্ত প্রহর গোনার পর সাতটি বিধানসভা কেন্দ্র নিয়ে গঠিত এই লোকসভা কেন্দ্রের একটা বড় অংশের সাধারণ ভোটারদের সাথে কথা বলে যে পরিসংখ্যান দাঁড়াচ্ছে তাতে এই কেন্দ্রে অনেকটাই এগিয়ে কীর্তি আজাদ। কিন্তু কেন?
১) ২০১৪ সালের পর বর্ধমান দুর্গাপুর লোকসভা কেন্দ্রের এই সাতটি বিধানসভা তে সাংগঠনিকভাবে তৃণমূল কংগ্রেস অনেকটা ঘর গুছিয়ে নেয়। তার ফলস্বরূপ ২০২১ এ এই সাতটি বিধানসভার মধ্যে ছয়টিতে জয়লাভ করে তৃণমূল কংগ্রেসের প্রার্থীরা। শুধুমাত্র দুর্গাপুর পশ্চিম কেন্দ্রে জয় পান লক্ষন ঘোড়ুই।।
২) এই লোকসভা কেন্দ্রের মোট ভোটারের সংখ্যা প্রায় ১৮ লক্ষ।তবে তাৎপর্যপূর্ণ এটা যে এই লোকসভায় মহিলা ভোটারের সংখ্যা প্রায় ৫০ শতাংশ।রাজনৈতিক মহল বলছে মহিলাদের একটা বড় অংশের ভোট ঘাস ফুল শিবিরের পক্ষে যেতে চলেছে তার কারণ লক্ষীর ভান্ডার প্রকল্পের সুবিধা একলাফে ফের দ্বিগুণ হয়ে যাওয়ার কারণে।
৩) গত লোকসভা নির্বাচনে জয়লাভের পর এসএস আলুওয়ালিয়ার সেভাবে জনসংযোগ না ঘটানো। বিশেষ করে করোনা কালে বিজেপির পক্ষ থেকে খুব বেশি সাধারণ মানুষের পাশে দাঁড়ানোর প্রক্রিয়া চোখে পড়েনি বলে অভিযোগ একটা বড় অংশের। লকডাউনের সময় সাধারণ আর্ত পীড়িত মানুষদের পাশে গেরুয়া শিবিরের নেতা-কর্মীরা সেভাবে দাঁড়ায়নি বলে অভিযোগ অনেকের।
৪) ২০২১ সালের বিধানসভা নির্বাচনের পর ভারতীয় জনতা পার্টির অনেক কর্মীদেরকে ঘর ছাড়া হতে হয়। তাদের পাশে দল সেভাবে না দাঁড়ানোর বড় অভিযোগ তুলেছিলেন কর্মীরা। সেই সমস্ত কর্মীদের অনেকের মন ভেঙেছে। যার ফল ভুগতে হতে পারে এবারের লোকসভা নির্বাচনে এই কেন্দ্রের বিজেপি প্রার্থীকে।
৫) এই কেন্দ্রের দুর্গাপুর ইস্পাত নগরীর বন্ধ এমএএমমসি, বিওজিএল,এইচ এফ সি কারখানা খোলার দাবিতে বিজেপি সাংসদদের লোকসভায় সরব না হওয়ার অভিযোগ।
৬)বর্ধমান -দুর্গাপুর লোকসভা কেন্দ্রের ভাতার, মন্তেশ্বর,গলসি বিধানসভা কেন্দ্রের সংখ্যালঘু ভোটের একটা বড় অংশ ঘাসফুল শিবিরের পক্ষে যাওয়ার প্রবল সম্ভাবনা। দুর্গাপুর থেকে ২০১৯ সালের নির্বাচনে ৭৪ হাজার ভোটে লিড পেয়েছিলেন বিজেপি প্রার্থী। তার অন্যতম প্রধান কারণ ছিল তার আগের বছরই দুর্গাপুর পৌরসভার নির্বাচনে সাধারণ মানুষকে ভোট না দিতে দেওয়ার অভিযোগ উঠেছিল তৃণমূল কংগ্রেসের বিরুদ্ধে। সেই সময় তৃণমূল কংগ্রেসের পশ্চিম বর্ধমান জেলা সভাপতি ছিলেন জিতেন্দ্র তিওয়ারি। সেই রাগ, ক্ষোভ এবং অভিমানের বহিঃপ্রকাশ ঘটেছিল লোকসভা নির্বাচনে। যার জন্য বর্তমানে বিজেপিতে যোগ দেওয়া জিতেন্দ্র তিওয়ারি কেও বারবার ভরা সভায় ক্ষমা চাইতে শোনা গেছে। তাই এই ৭৪ হাজারের ব্যবধান যে দুর্গাপুর থেকে এবার কমবে তেমন কথাও বলছেন রাজনৈতিক ওয়াকিবহাল মহল। এসএস আলুওয়ালিয়া এই ৭৪ হাজার ভোটের লিডের কারণেই সামান্য ভোটে জয়লাভ করেছিলেন গত লোকসভা নির্বাচনে।
৭) রাজনৈতিক বোদ্ধারা মনে করছেন এই সাতটি বিধানসভা কেন্দ্রের বহু গ্রামাঞ্চলে এখনো পর্যন্ত ভারতীয় জনতা পার্টির সংগঠন সেভাবে দানা বাঁধতে পারেনি। এছাড়াও গত লোকসভা নির্বাচনে “”বামেদের ভোট রামে”” গিয়েছিল এমন কথাও উঠে এসেছিল।গতবার লোকসভা নির্বাচনে এই কেন্দ্রের বাম প্রার্থী আভাস রায় চৌধুরীর প্রাপ্ত ভোট ছিল ১ লক্ষ ৬১ হাজার ৩২৯ টি।বামেদের এবার কংগ্রেসের সঙ্গে এই কেন্দ্রে আসন সমঝোতা হয়েছে। গতবার আসন সংযত ছিল না। তাই এবার বাম প্রার্থী ডক্টর সুকৃতি ঘোষালের ভোটের পরিমাণ বাড়তে পারে বলেও অভিমত রাজনৈতিক বোদ্ধাদের।
৮) তৃণমূল কংগ্রেসের গোষ্ঠীদ্বন্দ তাদের জন্য চিন্তার বিষয়, পাশাপাশি ভারতীয় জনতা পার্টির আদি এবং নব্য এই দুই গোষ্ঠীর লড়াই ভাবাচ্ছে গেরুয়া শিবিরকে।
সব মিলিয়ে তাই কীর্তি আজাদ এই কেন্দ্রে অনেকটাই এগিয়ে আছে বলে দাবী একটা বড় অংশের ভোটারদের। আগামী ১৩ তারিখ কত শতাংশ ভোট এই কেন্দ্রে পড়ে তার ওপরেও নির্ভর করছে অনেক কিছু। তবে এই কেন্দ্রের লড়াইটা যে অন্য কেন্দ্রের থেকে একটু বেশি হাড্ডাহাড্ডি তা স্পষ্ট প্রমাণিত হয়েছে এই কেন্দ্রে গেরুয়া শিবিরের প্রার্থী দিলীপ ঘোষ ও রাজ্যের শাসকদলের প্রার্থী কীর্তি আজাদের সমর্থনে প্রচারে হেবিওয়েটদের আনাগোনা দেখে।