দুর্গাপুর, ২১ ডিসেম্বর : শনিবার উল্লাসময় শহরে সবার অগোচরে একটি ছোট্ট দুর্ঘটনা ঘটে গেল দুর্গাপুরের একসময়ের গর্বের হাসপাতাল দুর্গাপুর ইস্পাত হাসপাতালে। খুব সাধারণ একটি ঘটনা। দুর্গাপুর ইস্পাত হাসপাতালের সিংহভাগ পরিষেবা এখন ঠিকা কর্মীদের দ্বারা পরিচালিত হচ্ছে। দারুন ব্যাপার। সরকারের খরচ কমেছে। কম পয়সায় মিলে গেছে হাসপাতালে কাজ করার মত কর্মী।কিন্তু আদৌ কি তারা হাসপাতালে কাজ করার যোগ্য? দুর্গাপুর ইস্পাত হাসপাতালে শনিবার একতলা মেল ওয়ার্ডে কাজ করছিলেন রিলিভার বি-জোন ভারতী এলাকার বাসিন্দা ধর্মা দাস।তার বয়স ৪৮ বছর।বেচারা ধর্মাবাবু জানতেনই না অক্সিজেন সিলিন্ডার কিভাবে খুলতে হয়। আর তাকেই কিনা দেওয়া হয় রোগীকে অক্সিজেন দেওয়ার জন্য অক্সিজেন সিলিন্ডার খোলার মত গুরুত্বপূর্ণ কাজের ভার। সেই কাজ করতে গিয়েই একটু এদিক-ওদিক হতেই প্রবল বেগে অক্সিজেন গ্যাস সেলেন্ডার থেকে বেরিয়ে ধর্মা দাসের বাম চোখে জোরালো আঘাত করে। অক্সিজেন গ্যাসের সেই জোরালো আঘাতে ধর্মা দাসের বাম চোখ চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তড়িঘড়ি তাকে নিয়ে যাওয়া হয় দুর্গাপুরের সিটি সেন্টারের একটি বেসরকারি চক্ষু হাসপাতালে। সেখানে দ্রুততার অস্ত্রপচারের পর এই মুহূর্তে তাকে দুর্গাপুরের বিধাননগরের একটি বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি রাখা হয়েছে। পাঠক বর্গের মনে হতে পারে কেন আমি ঘটনাটিকে ছোট্ট ঘটনা বলছিলাম প্রথমদিকে। তীব্র বেকারত্ব আর অভাবের জ্বালায় আজ এমন কর্মীর ছড়াছড়ি গোটা বাংলা জুড়ে। কিন্তু মেডিকেল ইউনিটের মত গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় ধর্মা দাসের মতো কর্মীদেরকে নিয়োগ করা কতটা যুক্তিপূর্ণ? রাজ্য এবং কেন্দ্রের শ্রম দপ্তর রয়েছে, বইয়ের পাতায় পাতায় লেখা রয়েছে শ্রম আইনের কথা। দুর্গাপুর ইস্পাত কারখানার শ্রমিক সংগঠনগুলি আবার দারুন লড়াই করেন কর্মীদের বোনাস বেতনের দাবিতে।
দুর্গাপুরের গর্বের হাসপাতাল দেখতে দেখতে আজ এ কোন হাসপাতালে পরিণত হলো দুর্গাপুর ইস্পাত হাসপাতাল? যেখানে ধর্মা দাসের মত প্রশিক্ষণ না পাওয়া রিলিভারদেরকে দিয়ে এমন গুরুত্বপূর্ণ কাজ করাতে গিয়ে হয় ধর্মা দাসদের বিপদ দেখে আনলেন আর তা না হলে রোগীদের বিপদ ঘনিয়ে আসছে।কংগ্রেস নেতা তথা দুর্গাপুর ইস্পাত কারখানার প্রাক্তন কর্মী দেবেশ চক্রবর্তী অভিযোগ করে বললেন, “”আমার মা দুর্গাপুর ইস্পাত হাসপাতালে শয্যা থেকে পড়েই মারা গিয়েছেন। কেউ কোন দায় নিলেন না। আসলে এখানে জোর যার মুলুক তার। এই ঠিকা কর্মীদের কারো কোনও প্রশিক্ষণ নেই। এরা সরকারি কোনো সুযোগ সুবিধা পান না। অথচ এদেরকে দিয়েই কাজ করানো হচ্ছে। “”দুর্গাপুর ইস্পাত কারখানা কর্তৃপক্ষ এখন মনঃনিবেশ করেছেন দুর্গাপুরের চারিদিকে ভাঙচুর চালানোর জন্য। বেকার যুবকদের সামান্য দোকান ঘর কিভাবে কখন বুলডোজার চালিয়ে গুড়িয়ে ফেলা যায় সেদিকেই নজর এখন দুর্গাপুর ইস্পাত কারখানা কর্তৃপক্ষের।দুর্গাপুর ইস্পাত হাসপাতালে চলছে “”দালাল রাজ “”।ঠিকা শ্রমিক দিয়ে গোটা হাসপাতাল চালানোর দায় এখন যেন কয়েকজন প্রভাবশালী দালালের কাঁধেই অর্পণ করে দিয়ে দুর্গাপুর ইস্পাত কারখানা কর্তৃপক্ষ কুম্ভকর্ণের ঘুমে ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন। গোটা সিস্টেমটাই চলছে “”মোটা কাটমানির” লোভে।আর তাতেই আজ নীরবে চোখ হারাতে বসেছে ধর্মা দাস।অসহায় তার পরিবার। ক্ষতিপূরণ কি আদৌ পাবে ধর্মা দাসের পরিবার? এরকম অনেক রিলিভার দুর্গাপুর ইস্পাত হাসপাতালে স্বল্প পয়সায় নিয়োগ করা হয়েছে। সবার যোগসাজসে এখন আর স্থায়ী এবং প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত দক্ষ শ্রমিক নিয়োগ বন্ধ হয়ে গেছে দুর্গাপুর ইস্পাত হাসপাতালে। তাই ধর্ম দাসদেরকে দিয়ে মেডিকেল ইউনিট এর মত গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় এমন ঝুঁকিপূর্ণ কাজ করানো হচ্ছে। সিটু নেতা বিশ্বরূপ বন্দ্যোপাধ্যায় জানালেন, “”আমরা বারংবার ম্যানেজমেন্ট কে এই বিষয়ে দফায় দফায় অভিযোগ জানানোর পরেও ম্যানেজমেন্টের ঘুম ভাঙেনি। অদ্ভুতভাবে তারা আজ নিরব। এক চূড়ান্ত অস্থিরতা তৈরি হয়েছে দুর্গাপুর ইস্পাত কারখানায় এবং দুর্গাপুর ইস্পাত হাসপাতালেও। চরম অব্যবস্থা চলছে এই পাবলিক সেক্টরে। কারখানাতেও দেখা যাচ্ছে কোকওভেন সম্পর্কে যে শ্রমিক কিছুই জানেনা তাকে কাজ করাতে গিয়ে সেই শ্রমিক কয়লা চাপা পড়ে মরছেন। আমরা এই ঘটনার তীব্র প্রতিবাদ জানাবো। আমরা চাইবো ধর্মা দাসের পরিবার উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ পাক এবং দুর্গাপুর ইস্পাত হাসপাতাল থেকে প্রশিক্ষণ ছাড়া যে সমস্ত কর্মীদেরকে নিয়োগ করা হয়েছে তাদেরকে এই ধরনের গুরুত্বপূর্ণ কাজকর্ম থেকে অবিলম্বে সরিয়ে দেওয়া হোক। “”শ্রমিক সংগঠনগুলির কথায় দুর্গাপুর ইস্পাত হাসপাতাল এখন সেই হাসপাতালের ঠিকা শ্রমিকদের কাছেই “”মৃত্যুফাঁদ””হয়ে উঠছে।চূড়ান্ত বেকারত্ব আর অর্থ উপার্জনের জন্য আজ ধর্মা দাসের মত মানুষেরা যে কাজ জানেন না সেই কাজ করতে ছুটে যাচ্ছেন। অন্ধ ধৃতরাষ্ট্রের মতো বসে আছে দুর্গাপুর ইস্পাত কারখানা কর্তৃপক্ষ। কিসের আশায়? ধর্মা দাসদের মত মানুষদের জীবনের এই চরম পরিণতির জন্য? যে দুর্গাপুর ইস্পাত হাসপাতাল একদিন দুর্গাপুর সহ আশপাশের অঞ্চলের মানুষদের কাছে বিশ্বাস, ভরসার একমাত্র অন্যতম প্রধান হাসপাতাল ছিল আজ সেই হাসপাতাল কাদের জন্য রসাতলে পৌঁছে গেল? এর জন্য শুধু ইস্পাত কারখানা কর্তৃপক্ষই নয়, দুর্গাপুরের শ্রমিক সংগঠনগুলিও নিজেদের দায় এড়াতে পারেন না।যে পরিকাঠামো আজও দুর্গাপুর ইস্পাত হাসপাতালে বর্তমান, দুর্গাপুরের যেকোন বেসরকারি সুপার স্পেশালিটি হাসপাতালকে দা চ্যালেঞ্জ জানানোর জন্য যথেষ্ট। দুর্গাপুর ইস্পাত হাসপাতালে অভাব যদি কোথাও থেকে থাকে তাহলে তা হল এই হাসপাতালকে শক্ত হাতে পরিচালনা করার জন্য নিয়োজিত একটি স্বচ্ছ পরিচালকমন্ডলী।